সৈয়দ আশরাফ আলী
আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ জন্মগ্রহণ করেন, যাঁদেরকে ধ্রুব নক্ষত্রের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কারণ, তাঁরা এমন মহিমান্বিত বৈশিষ্ট্যের প্রোজ্জ্বল দ্যুতিতে ভাস্মর থাকেন, যার নিশ্চিন্ত-নিরাপদ ইশারায় আপামর জনগণ সামনে চলার পথ খুঁজে পায়। সমাজে এমন সব ক্ষণজন্মা মানুষের আবির্ভাবের কারণেই সমাজ, দেশ ও জাতি এগিয়ে যায় অগ্রগতি ও প্রগতির দিকে; বেগবান হয় সভ্যতার পথচলা। তাঁরা সাধারণের স্বার্থ ও কল্যাণে আপন স্বার্থ বিসর্জন দেন; অবলীলায় ত্যাগ করেন জাগতিক লোভ-লালসার ঐশ্বর্যময় সম্ভার। তাঁরা সত্যকে সত্য বলে বিশ্বাস করতে দৃঢ়চিত্ত; মিথ্যাকে মিথ্যা বলে ঘৃণা করতে নিঃশঙ্ক, দ্বিধাহীন। বস্তুত তাঁদের আত্মত্যাগের স্বেদাক্ত ইটেই রচিত হয় সমৃদ্ধ সমাজ-সভ্যতার সুদৃঢ় বুনিয়াদ।
সৈয়দ বদরুদ্দোজা ছিলেন এমনই আলোকসম্পন্ন মানুষের প্রতিনিধি। এই অসাধারণ বাগ্মী পুরুষ অকুতোভয়ে, দ্বিধাহীনচিত্তে মুসলমানদের স্বার্থে কথা বলেছেন। তৎকালীন ভারতবর্ষের সাড়ে সাত কোটি মুসলমানের একান্ত সুহৃদ, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখের বিশ্বস্ত সাথী সৈয়দ বদরুদ্দোজা নানা প্রতিকূল ঝড়-ঝঞ্ছা, তরঙ্গ-সংকুল বৈরি পরিবেশের মধ্যেও একাকী এক স্বয়ংসম্পূর্ণ ইনস্টিটিউশনের মতো যেভাবে স্বজাতি, স্বসমাজের খিদমতের আঞ্জাম দিয়েছেন, তা গৌরবময় ইতিহাস হিসেবে স্মরণীয়, আমাদের জন্য অনুকরণীয়।
মুসলিম মিল্লাতের তেজোদৃপ্ত কণ্ঠস্বর, পঞ্চাৎপদ জাতির জরাভয়ের প্রতীক এই অসাধারণ কর্মবীর ১৮৯৭ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জানা যায়, মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব প্রদত্ত এক শাহী ফরমানবলে সৈয়দ বদরুদ্দোজার পূর্ব পুরুষগণকে পাঠানো হয় মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদাবাদের তৎকালীন নবাব ভারত-সম্রাটের ফরমান মোতাবেক যে গ্রামে সৈয়দ-পরিবারের বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন, আজও তা ‘সৈয়দ কুলুট' নামে পরিচিত।
আলোকোজ্জ্বল ও বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী সৈয়দ বদরুদ্দোজা কলিকাতাস্থ আলিয়া মাদরাসা থেকে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে বৃত্তিসহ প্রবেশিকা পরীক্ষায় (এখনকার এসএসসি) উত্তীর্ণ হন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি দর্শন শাস্ত্রে অনার্সসহ এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। একই সঙ্গে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএল ডিগ্রিও লাভ করেন। অসাধারণ মেধাবী ছাত্র সৈয়দ বদরুদ্দোজা বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অনন্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করে উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও অসুস্থ শরীরের জন্য ডাক্তারী পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ ঘোষিত হন। এই ঘটনাটিই বোধ হয় তাঁর জন্য শাপে বর হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয়ার সুযোগ নষ্ট হওয়ার জন্য তাঁকে বাঁধা-ধরা চাকরির সীমিত গন্ডির মধ্যে একান্ত বশংবদ সরকারি চাকরিজীবীর মতো জীবন কাটাতে হয়নি; তাঁর সামনে উন্মুক্ত হয় জনসেবা ও স্বাধীন মত প্রকাশের এক সুবিশাল ক্ষেত্র। আর এ কারণেই বোধহয় আমরা একজন স্বাধীনচেতা, নিঃশঙ্ক, স্বার্থত্যাগী এক ‘সম্পন্ন' সৈয়দ বদরুদ্দোজাকে অর্ধ শতাব্দীরও অধিককাল প্রবল দাপটে বিচরণ করতে দেখি রাজনীতি, সমাজসেবা তথা ভারতীয় সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকার আদায়ের কণ্টকাকীর্ণ ময়দানে। ভারতীয় মুসলমানদের সেবায় তিনি তাঁর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছিলেন পরিপূর্ণভাবে। ছাত্র জীবন থেকেই অসাধারণ বাগ্মী হিসেবে তিনি প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেন। ১ম বর্ষ আই এ ক্লাসে অধ্যয়নকালেই একটি বিশাল জনসভায় ৪ ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতা প্রদান করে তিনি রীতিমতো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। শুধুমাত্র তাঁর বাগ্মিতা তাঁকে সান্নিধ্য এনে দেয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের মতো অসাধারণ ব্যক্তিত্বের। বাংলা ও ইংরেজিতে তাঁর অপূর্ব বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে দেশবন্ধু সিআর দাস সৈয়দ বদরুদ্দোজাকে সরাসরি কলকাতা করপোরেশনের এনটালী মার্কেটের সুপারিনটেনডেন্ট পদে নিয়োগ করেন। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে কলকাতাস্থ হগ মার্কেটে (নিউ মার্কেট) কর্তব্যরত থাকাকালীন এই নির্ভীক সংগ্রামী পুরুষ কলকাতা করপোরেশনের তদানীন্তন মেয়রের অন্যায় আচরণের তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং অন্যায় আদেশ মান্য করার চেয়ে চাকরি থেকে পদত্যাগ করা শ্রেয় মনে করেন। মেয়রের অন্যায় নির্দেশের বিরোধিতা করে চাকরি ত্যাগ করার কয়েক বছর পর এই একই সৈয়দ বদরুদ্দোজা নিজেই ১৯৪৩ সালে কলকাতা করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। অবিভক্ত বাংলায় তিনিই ছিলেন কলকাতা করপোরেশনের চতুর্থ এবং সর্বশেষ মুসলমান মেয়র।
১৯৩০ সালে কলিকাতার অ্যাবার্ট হলে বক্তৃতা প্রদানকালে তিনি কায়েদ-এ-আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতার জন্য জিন্নাহ তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে অভিনন্দিত করে তাঁকে যে দুর্লভ সম্মান দেখান, তা ছিল এক নজিরবিহীন ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে সৈয়দ বদরুদ্দোজার অনন্য প্রতিভা ও বিরল ব্যক্তিত্বের যে আভাস পাওয়া যায় তা কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়; এর মহীরুহ সদৃশ এক বিশাল ব্যক্তিত্বের প্রমাণ তিনি রেখে গেছে সারাজীবন, তাঁর কর্মে, চিন্তায়, বিশ্বাসে।
১৯৩৩ সালে সৈয়দ বদরুদ্দোজা কলকাতা করপোরেশনের কাউন্সিলার পদে নির্বাচিত হন এবং শেরে বাংলা ও সুভাষ চন্দ্র বসুর দুর্লভ সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৯৩৭ সালে তিনি এমএলএ ও এমএলসি উভয় পদে নির্বাচিত হবার দুর্লভ গৌরব লাভ করেন। ১৯৪০ সালে কলকাতা করপোরেশনের একজন সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রে কলঙ্কলেপন করার প্রয়াস নিলে সৈয়দ বদরুদ্দোজা প্রকাশ্য মিটিংয়ে তার তীব্র প্রতিবাদ করে ঘোষণা করেন যে, ইসলাম ধর্মে এ ধরনের গৃণিত আচরণের কোনো স্থান নেই। তাঁর এই প্রশংসনীয় আচরণ এক বিরাট সংকটময় পরিস্থিতি থেকে কলকাতা করপোরেশনকে সেদিন রক্ষা করে এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু স্বয়ং সৈয়দ বদরুদ্দোজাকে তাঁর এই মহানুভবতার জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানান। ১৯৪৩ সালে কলকাতা করপোরেশনের মেয়র পদে সৈয়দ বদরুদ্দোজা নির্বাচিত হন এবং তার প্রতিদ্বনদ্বী ছিলেন ভারত বিখ্যাত ধনকুবের এম এম ইস্পাহানী। মেয়র নির্বাচিত হবার পর দুর্ভিক্ষের কবল থেকে জনসাধারণকে বাঁচাবার প্রয়াসে তিনি স্যার উইন্সটন চার্চিলসহ পৃথিবীর বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কাছে যে ব্যক্তিগত আবেদন পাঠান তাতে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়।
ভাইসরয়ের ওয়ার কাউন্সিলে যোগদান করার অপরাধে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করা হলে একজন একনিষ্ঠ ভক্ত হিসেবে সৈয়দ বদরুদ্দোজাও মুসলিম লীগ ত্যাগ করেন। কায়েদে আযমের মতো বিশাল ব্যক্তিত্ব টেলিফোনে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার জন্য সৈয়দ বদরুদ্দোজাকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ জানান। কিন্তু এই অতি দুর্লভ অনুরোধ সত্ত্বেও সৈয়দ বদরুদ্দোজা তাঁর প্রিয় নেতা শেরে বাংলাকে পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করেন।
১৯৪৭ সালের পার্টিশনের পর তিনি একজন নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভায় ১৯৪৮ সালে নির্বাচিত হন। ভারতের প্রতিটি চাকুরিতে মুসলমানদের জন্য অন্ততপক্ষে ৫% পদ রিজার্ভ করার জন্য তাঁর প্রস্তাব রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৫০ সালে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সাড়ে তিন মাসব্যাপী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় বিপন্ন মুসলমানদের রক্ষা করার প্রয়াসে তিনি দিবারাত্র পরিশ্রম করেন এবং দুই দুইবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। তাঁর নিরাপত্তার জন্য মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় সশস্ত্র দেহরক্ষীর ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিলে তিনি ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৫০ সালে তাঁকে প্রথমবারের মতো সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। সাম্প্রদায়িকদের হাতে কলকাতা চেম্বার অব কমার্সের মি. ক্যামেরুনের প্রকাশ্যে দিবালোকে নির্মম হত্যাকান্ডের পর তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জহরলাল নেহেরু কলকাতায় ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হতে বাধ্য হলে, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে সৈয়দ বদরুদ্দোজা প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন পেশ করেন এবং সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, শুধুমাত্র হাওড়ার একটি জুট মিলেই অন্ততপক্ষে ১৭০০ মুসলমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৫২ সালে তাঁরই অনুপ্রেরণায় ত্রিদিব চৌধুরী প্রথমবারের মতো লোকসভায় নির্বাচিত হন। পরবর্তী পর্যায়ে এই ত্রিদিব চৌধুরীই ভারতের রাষ্ট্রপতি হবার জন্য বিরোধী দলের সম্মিলিত মনোনয়ন লাভ করেন।
১৯৫৩ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম কনভেনশনের সভাপতি হিসেবে আলীগড়ে সৈয়দ বদরুদ্দোজা ইংরেজি ও উর্দুতে যে সাড়ে চার ঘণ্টাব্যাপী অনলবর্ষী বক্তৃতা দেন তা ভারতে সম্পূর্ণরূপে তাৎক্ষণিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। অদ্যবধি তা ভারতে নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হয়। ঐ এতিহাসিক বক্তৃতার ফলে আলীগড় ও দিল্লির মুসলমানেরা তাঁকে ‘কায়েদ-এ-আকবর' উপাধি প্রদান করে। কিন্তু ‘সিকিউলিয়ার' ভারত সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে। প্রতিবেশি রাষ্ট্রে গোপনীয় সামরিক তথ্য পাচার করার মিথ্যা অভিযোগে সুদীর্ঘ সাড়ে তিন মাস কারারুদ্ধ রাখার পর মধ্য রাত্রিতে এক সদস্যের একটি গোপনীয় ট্রাইব্যুনালের সম্মুখে তাঁকে হাজির করা হয়। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়ে তিনি সুদীর্ঘ চার ঘণ্টার এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা প্রদান করেন। বিমুগ্ধ বিচারক তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে সম্পূর্ণ নির্দোষ হিসেবে মুক্তি প্রদানের নির্দেশ দেন।
১৯৫৭ সালে নির্দলীয় সদস্য হিসেবে তিনি পুনরায় বিধান সভায় নির্বাচিত হন। একজন নির্বাচিত সদস্য হিসেবে তাঁকে ১৯৫৮ সালে একটি দলিল স্বাক্ষর করতে নির্দেশ দেয়া হয় যাতে দাবি করা হয় যে, কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সৈয়দ বদরুদ্দোজা উক্ত দলিল স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানালে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে অভিযুক্ত করার জন্য এবং সেই সঙ্গে সদস্য পদ বাতিল করে অন্যান্য কঠোর শাস্তি প্রদানের প্রয়াসে বিধান সভার একটি বিশেষ অধিবেশনে সৈয়দ বদরুদ্দোজা বীরদর্পে ঘোষণা করেন যে, তিনি ভারতীয় সংবিধানের প্রতি অনুগত, কিন্তু কংগ্রেসী প্রশাসনের কাছে বিন্দুমাত্র অনুগত নন। তাঁর অকাট্য যুক্তি ও সুতীব্র বাগ্মিতার চাপে অভিযোগ উপস্থাপনকারী মন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় (পরবর্তী পর্যায়ে যিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন) এবং মীরজাফরের বংশধর নওয়াব কাজেম আলী মির্জা তাদের মিথ্যা অভিযোগ বিনা শর্তে প্রত্যাহার করতে এবং ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন। শুধু তাই নয়, এই দুর্দম মুজাহিদের কণ্ঠরোধ করার জন্য কংগ্রেস সরকার ১৯৫৮ সালেই তাঁকে শিক্ষামন্ত্রী হবার জন্য সরাসরি প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু সত্যের পূজারী, ইসলামের একনিষ্ঠ খাদেম মুসলিম-বিরোধী সরকারের সে প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। (চলবে)